জিরো বাউন্ডারি কবিতার পঞ্চম সংখ্যার জন্য লেখা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট মে মাসের ১০ তারিখ। দুটো কবিতা বা কবিতা বিষয়ক লেখা নিজের এক কপি ছবি সমেত পাঠিয়ে দিন আমাদের ইমেলে-0boundarykabita17@gmail.com

অনুপ বৈরাগী

দীপ্ত বসন্ত



একটা দূর্ঘটনা আর অনেকগুলো প্রশ্ন ! দুপুর ১২:১৫ থেকে রাত ৯টা অবধি। দুর্ঘটনার জায়গা থেকে বেসরকারি নার্সিংহোমের করিডোর পেরিয়ে পাটুলী থানার সেকেন্ড অফিসারের টেবিল পর্যন্ত । পথচলতি মানুষের অত্যুৎসাহী জটলা থেকে বাইপাসের জনপ্রিয় ধাবার রুমালিরুটির থালায় ঘুরপাক খাচ্ছে হোলির দিনে। একটা দুর্ঘটনা ও কিছু অশালীন প্রশ্ন!


প্রদীপ্ত সকাল সকাল ফর্মটা ডাউনলোড করলো । প্রিন্ট আউট করার পর যখন প্রশান্ত"র চায়ের কাপের পাশে দৈনিক কাগজের ওপর রেখেছিলো প্রশান্ত'র সকালের প্রশান্তি ভোল বদলে যে তুমুল অশান্তির আবহ তৈরি করতে পারে সে আন্দাজ প্রদীপ্ত আগেই করেছিল " স্বাতী ! স্বাতী ! একবার দেখে যাও তোমার ছেলের কান্ড! " রান্নাঘরের দিকে  সারসের মত গলা বাড়িয়ে কথা কটা বলে প্রদীপ্তর দিকে নেমে এলো রাগচোখ " কি ভেবেছো কি তুমি। কলেজে ঢুকতে না ঢুকতেই ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শিখে গেছো ! ডিসিশন নেওয়ার আগে জানানোর প্রয়োজন পর্যন্ত মনে করলে না!"
সকালের আদরের চা উষ্ণতার লীনতাপ হারিয়ে কখন জোলো হয়ে গেছে। টবের বনসাইয়ের ডালে কেমন আটকে আছে সদ্যোজাত সূর্য । কিছুতেই ডালের ফাঁক গলে উঠতে পারছে না সে। স্বাতীর চেনা সকাল আজ বড় অচেনা ঠেকছে। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে স্বাতী শুনতে পেলো ছেলের নির্লিপ্ত গলা " এটা তো কোন ডিসিশন সে অর্থে নয় বাবা। এটা নেহাতই আমার ইচ্ছে । ডিসিশন তো তোমরা নেবে বা নেক্সট জেনারেশন । জাস্ট একটা কমিটমেন্ট । তোমরা আমার ইচ্ছেটুকুর সম্মতি দেবে। ডিসিশন নেওয়ার ব্যাপারটা তোমাদেরই থাকছে। সো ডোন্ট ওরি বাবা"

টি টেবিলে রাখা পেপারগুলোতে চোখ বুলিয়ে স্বাতীর চোখে গলে যাচ্ছে বরফ কুচি। নিম্নমুখী জলপথ মুছে যাচ্ছে আঁচলের সঘন ছোঁয়ায়। ওরা তো ভাবেনি এতকিছু যা দীপ্ত এতটুকু বয়সে ভেবেছে। নিজের সংসার ছাড়া নিজের ছেলে ছাড়া অন্য কিছু তো বাবার ফুরসত হয়নি। দীপ্তকেও নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির বাইরে তেমন তোমার কিছু দিতে পারে নি ওরা। তবু স্কুল ছাড়ার পরে কেমন বড় গেছে দীপ্তটা। ভাবতে ভাবতে স্বাতীর বুকটা গর্বে ভরে যাচ্ছে । দীপ্তকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বললো " দে বাবা কোথায় সই করতে হবে!"
দলভারি করার জন্যে ডেকে স্বাতী যে এরকম বিপক্ষ শিবিরে মাথা গলাবে সেটা একেবারেই আগাম ঠাহর করতে পারেনি প্রশান্ত। বেশ চুপসে গেছে বোঝা গেল। ঠান্ডা চা সরবতের মত গলায় চালান দিয়ে বাজারের ব্যাগ হাতে মুখ গোমড়া করে বেরিয়ে গেল। 



- হ্যালো ! প্রশান্ত বাবু বলছেন?
- হ্যা ! আপনাকে তো....
  - আমি পাটুলী থানা থেকে বলছি। প্রদীপ্ত ...
  - কি হয়েছে দীপ্তর...
  - আপনাকে খুব শীঘ্রই নার্সিংহোম আসতে হবে। একটা অ্যাকসিডেন্টে......


পরের কথাগুলো ঠিক কানে আসেনি প্রশান্তর। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু সংলাপ পাঁচিলের ওপর বসে থাকা কাকের কা কা ডাকের মত মিলিয়ে যাচ্ছে জামরুল গাছটার ডাল থেকে সজনের ডালের দিকে। নরম হাওয়ায় কতগুলো সজনে ফুল ভাসতে ভাসতে নেমে আসছে।
সকালে আবির দিয়ে যে ছেলেটা মাসির বাড়ি যাবে বলে বেরিয়েছিল....নরেন্দ্রপুর থেকে পাটুলী কত আর পথ .. . স্কুটি নিয়ে বেরোল। স্বাতী নিজে হেলমেট মাথায় পরিয়ে বলেছিল " আস্তে চালাস বাবা ! আজ হোলি। দেরি করিস না। সাবধানে ফিরিস " উত্তরে হেসে দীপ্ত বলেছিল " মা ! নিজে সাবধান হলেই কি দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব? ট্রাফিক নিয়ম মেনে তুমি চলছো আর তোমার দিকে যে ছুটে আসছে ট্রাফিক আইনকে থাম্বস আপ করে তার দায়িত্ব তুমি নিতে পারো কি !"
"তুই না বড্ড কথা বলিস। অলক্ষুণে কথা গুলো না বললেই চলছিল না। সাবধানের মার নেই।অন্যেরা কি করবে না ভেবে সবাই নিজে সাবধান হলেই ল্যাটা চুকে যায় বাবু !"


থানা থেকে ফোন পাওয়ার পর তড়িঘড়ি চলে এসেছিল প্রশান্ত আর স্বাতী বাইপাসের সেই নার্সিংহোমে। আইসিইউ'র জানলা দিয়ে একবার দেখেছিলো। দীপ্তর শরীর জুড়ে ব্যান্ডেজ। ব্যান্ডেজ চুঁইয়ে ছোপ ছোপ কালচে লাল দাগ। এখন ভেন্টিলেটারে। মনিটর আর সিরিঞ্জ পাম্পের নানারকম শব্দ আর আলোর শিম্ফনি।

" কোমাতে আছে । কোন রেসপন্স এই মূহুর্তে নেই। সেরিব্রাল হেমারেজ হয়েছে। মাল্টিপল ফ্র্যাকচার। চেস্ট ট্রমা । আপাতত যেটুকু করার আমরা করেছি। ভেন্টিলেটারে আছে। বাকিটা কিরকম প্রোগ্রেস করছে তারওপর সব কিছু নির্ভর করছে। ইন্সপেক্টর দত্ত এসেছেন। কিছু কথা বলবেন আপনাদের সাথে। জাস্ট কিছু ফর্মালিটিজ... বুঝতেই পারছি এখন আপনাদের মনের অবস্থা ঠিক কি ! তবুও..."
প্রশান্তর হাতকে দুহাতে চেপে ডা: রায় কথা গুলো বললেন। সহমর্মিতার হাত কাঁধে রেখে ঢুকে গেলেন নিজের চেম্বারে ।


সপ্তা দুয়েক আগে যে ছেলেটা কমিটেড হলো মরণোত্তর দেহদানের...সকাল সকাল ফর্ম ফিলাপ করে মেডিক্যাল কলেজে জমা দিয়ে এলো। এই ছেলেটাই আজ আইসিইউ কেবিনে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে...

তিনদিন হয়ে গেছে। কোন রকম সাড়া নেই। ডা: রায়  এই মাত্র বলে গেলেন " প্রশান্ত বাবু সরি টু সে প্রদীপ্ত ' র ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে। এরকম অবস্থায় আশা একপ্রকার নেই। আমরা ততক্ষণ ভেন্টিলেটারে রাখবো যতক্ষণ হার্ট চলছে"

একটু থেমে বলতে শুরু করলেন "গতকাল আপনার স্ত্রীর কাছ থেকে আপনাদের ছেলের কমিটমেন্টের কথাটা শুনছিলাম । খুবই এনকারেজিং। তবে আরেকটা ব্যাপার আপনাদের সাথে আলোচনা করতে চাই...যেহেতু ওর ব্রেন ডেথ হয়ে গেছে কিন্তু ওর্গ্যানস আর স্টিল লিভিং...এরকম অবস্থায় আপনারা চাইলে ওর শরীর থেকে ওরগ্যান ডোনেট করা সম্ভব...মানে লিভার , হার্ট , কিডনি , কর্নিয়া , এরকম একাধিক অরগ্যান একাধিক জনের দেহে প্রতিস্থাপন করা যায়। যদিও এ সিদ্ধান্ত আপনাদের একান্তই ব্যক্তিগত...প্রদীপ্ত'র মানসিকতা কে সম্মান করে কথা গুলো বললাম... মরণোত্তর দেহদানে যে উপকার সমাজের হবে এটা তার থেকে অনেক অনেক বেশি গুন উপকার হবে।ওর অঙ্গ ফিরিয়ে  দেবে একাধিক জনের জীবন। ভেবে দেখুন...."

ডাক্তার চলে গেছেন । চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত'র কেমন অসহায় লাগে । ছেলেটার দেহে এখনও প্রান আছে...না..না...এ কিভাবে করবে । তাই কি করে হয়...


এত কিছুর মধ্যেও কিছুটা হলেও আজ হালকা লাগছে স্বাতীর। হাসিমুখ দীপ্তর ফটোফ্রেমের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো প্রশান্ত। চোখের জল মুছে স্বাতী বললো " আমাদের ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে আমরা টেরই পেলাম না । একটা নিভন্ত প্রদীপ কতগুলো প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে যায় আমরা খেয়াল করিনি কেন আগে ?... ফর্ম দুটো টেবিলে রাখা আছে । অফিস যাওয়ার পথে জমা দিয়ে যেও। যদি আমরাও কোন কাজে লাগি..."

প্রশান্ত'র জামা ভিজে যাচ্ছে স্বাতীর কান্নায়। স্বাতীর কপালে ঝরছে প্রশান্তর আবেগজল। ফটোফ্রেমে প্রাণখোলা হাসি হাসছে দীপ্ত বসন্ত...!



ছবি ঋণঃ-- ইন্টারনেট 


No comments:

Post a Comment