জিরো বাউন্ডারি কবিতার পঞ্চম সংখ্যার জন্য লেখা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট মে মাসের ১০ তারিখ। দুটো কবিতা বা কবিতা বিষয়ক লেখা নিজের এক কপি ছবি সমেত পাঠিয়ে দিন আমাদের ইমেলে-0boundarykabita17@gmail.com

কবি সুশীল হাটুইয়ের সাক্ষাৎকার

সিনিয়র কবি সুশীল হাটুই । তিনি বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাসিন্দা। নব্বই দশকের এই স্বনামধন্য কবিকে অনেকেই তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে চেনেন। নিরহঙ্কার ও খুবই চুপচাপ এই কবির লেখা আমাদের অত্যন্ত প্রিয়। তাহলে আসুন, আমরা আজ তাঁর সম্পর্কে ও জিরো বাউন্ডারি কনসেপ্ট সম্পর্কে তাঁর কিছু বক্তব্য জানি ।

তাঁর সাক্ষাত্কার নিয়েছেন এই সময়ের এক তরুন কবি শান্তনু পাত্র । লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য 
বিষ্ণুপুর নিবাসী এই কবির প্রচেষ্টা নিজস্বতার ছাপ রাখে।





নমস্কার সুশীল বাবু। আজ আমি জিরো বাউন্ডারি কবিতা গ্রুপ থেকে এসেছি আপনার সাক্ষাৎকার নিতে। আমি আপনার মুখ থেকেই জেনে নেব আপনার কবিতাজীবন ও কবিতাভাবনার কথা।

    ধন্যবাদ শান্তনু। তোমাকে ও জিরো বাউন্ডারি কবিতা গ্রুপকে আমার অনেক অনেক ভালোবাসা।


১. আপনি কবিতায় কীভাবে এলেন?


উঃ    তখন স্কুলে প্রতিবছরই "কিশোর" নামে একটি পত্রিকা বেরতো। আমি সেই পত্রিকার জন্য আমার একটা কবিতা দিয়েছিলাম। কবিতাটি কিশোরে ছাপা হয়েছিল। তার পরের বছরও ওই পত্রিকাতেই আমার একটা কবিতা ছাপা হয়েছিল। তখনকার মতো কবিতাপর্ব শেষ।




২. তারপর আবার কখন শুরু করলেন?


উঃ   আমি কলেজজীবনে এসে আবার কবিতা লেখা শুরু করলাম। অনেক কবিতা লিখলাম। বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতে লাগলাম। কিন্তু কোনো পত্রিকাতেই আমার কবিতা স্থান পায়নি। আমি হতাশ হয়ে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলাম। অথবা লিখলেও খুবই কম লিখেছি।




৩. আবার কখন কবিতায় ফিরলেন?

উঃ   নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে।



৪. আপনার কবিতাজীবনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?


উঃ    শ্রী প্রভাত চৌধুরী। অনেক বছর আগে উনি আমাকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, "তোমার ভিতর কবিতা আছে।" উনি আমাকে 'কবিতাপাক্ষিক'-এ লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলছি, উনি আমাকে প্রশ্রয় না-দিলে আমার কবিতাচর্চা বন্ধ হয়ে যেত।




৫. আপনি কি আফজল আলির জিবাক পড়েছেন? জিবাক পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?


উঃ   পড়েছি। জিবাক পড়ে আমার মনে হয়েছে, জিবাক কোনো তত্ত্ব নয়। জিবাক এক সমন্বয়বাদী দর্শন। এই দর্শনে Elimination-এর চেয়ে Inclusion-এর ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে।




৬. জিবাকের হাত ধরে কবিতা কীভাবে উন্নত হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?


উঃ    কবি শিল্পীরা চিরদিনই বন্ধনমুক্ত। Boundary-র বিলোপসাধন করে জিবাকের হাত ধরে কবিতা শূন্য থেকে অনন্তে এবং অনন্ত থেকে শূন্যে এসে কবিতার নতুন ডাইমেনশন তৈরি করতে পারে। এখানে শব্দ ছন্দ বা প্যাটার্ন কোনো কিছুই তার অচ্ছুৎ নয়।





৭. বাংলা কবিতা কীভাবে জাড্য থেকে মুক্ত হবে?


উঃ    আমরা যতই এই সময় ও অনাগত সময়ের সমস্যাগুলিকে দেখতে পাই, কেউ কেউ তার চেয়ে বেশিই দেখতে পান। শুধু তাই নয় তাঁরা সমস্যার সমাধানও খোঁজেন। জিবাক এই সময়ের কবিতার জাড্যকে চিহ্নিত করেছে। আর এই জাড্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শব্দ নিয়ে নিরন্তর খেলা, শব্দের মধ্যবর্তী জড়তাকে ভেঙে যে কোনো দিকেই তার যাত্রার অভিমুখ খোলা রেখেছে। কেননা তার কোনো LOC বা Boundary নেই।






৮.  জিবাক ছন্দকে স্বীকৃতি দিয়েছে।  এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?


উঃ   অন্ত্যমিলে লেখা কবিতা শব্দের অধীনে চলে যায় - এ কথা সত্যি। জিবাক যেহেতু এক সমন্বয়বাদী দর্শন তাই কাউকে অচ্ছুৎ রাখলে জিবাকের উদারপন্থায় সংকীর্ণতা এসে যায়। ছন্দ হারিয়ে গেলে অনাগত সময় আমাদের অদূরদর্শীতাকেই দায়ী করবে। শুধু তাই নয়, নতুন ছন্দ সৃষ্টি করে ভিন্ন রুচির কবিতা লেখার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যাবে। ভেবে দেখো, এখন যেসব রুব্রিক কবিতা লেখা হচ্ছে, তুমিও তো লিখেছ, তাও কিন্তু লাইন, মাত্রা এবং শব্দের অধীন।





৯. কবিতায় পাঠকের অংশগ্রহণ কীভাবে ফলপ্রসূ হয়?


উঃ    Open ended কবিতার না-বলা কথা পাঠক নিজস্ব মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শনাক্ত করেন। যদিও সেই শনাক্তকরণ আপেক্ষিক। যদি একটি কবিতার শেষ অংশ অথবা মাঝের অংশের কিছুটা শূন্য রেখে পাঠককে সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয় তাহলে কবি ও পাঠকের দূরত্ব কমে যাবে। শুধু তাই নয় কবি যেভাবে লিখেছেন হয়তো দেখা যাবে পাঠকের লেখা তাঁর চেয়ে উন্নত।





১০. হাইব্রিডিটি বা স্যান্ডউইচ সিস্টেম গ্রহণের ফলে কবিতার কী লাভ হবে?


উঃ   হাইব্রিডিটি বা স্যান্ডউইচ সিস্টেমের কবিতায় একাধিক স্তর থাকে। সে স্তরের ভিতর বিভিন্ন ঘরানার চিন্তন ঢুকিয়ে দেবার ফলে কবিতার অন্তর্গত বিষয় ও ভাবনা প্রচলনের ঊর্ধ্বে গিয়ে অপ্রচলনকে ছড়িয়ে দেবে। এতে কবিতা আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।






১১. আপনার মতে উত্তর আধুনিকতা ও জিবাকের পার্থক্য            কী?


উঃ   জিবাক মূলত এক সমন্বয়বাদী দর্শন। এখানে শুধু উত্তর আধুনিকতাই নয়, সমস্ত তত্ত্বকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। উত্তর আধুনিকতা যতটা মেধা নির্ভর ততটা হৃদয়নির্ভর নয়। জিবাক মেধার সঙ্গে হৃদয়ের মেলবন্ধন ঘটিয়ে কবিতা নির্মাণের উপর জোর দিয়েছে।





১২. আপনার কী মনে হয়, উত্তর আধুনিক কালখন্ড শেষ হয়ে গেছে?


উঃ   কোনো ইজমই শেষ হয় না। তার কিছু সমর্থক থেকেই যায়। পৃথিবীতে নাৎসিবাদ শেষ হলেও তার কছু সমর্থক আছে। এখনো অনেকেই মডার্ন কবিতা লিখছেন, আবার কেউ পোস্টমডার্ন কবিতা লিখছেন। উত্তর আধুনিকতাকে কালখন্ডের প্রবণতা বলা হয়েছে। সেই প্রবণতার লক্ষণ হিসাবে বহুরৈখিক বহুকৌণিক বহুত্ববাদী বিদিশামশগুল কবিতাগুলির পাশে এখন ফুটে উঠছে অন্য ভার্সন। অনেকেই তাদের কবিতাকে পোস্টপোস্টমডার্ন বলতে পছন্দ করেন। তাদের ভার্সনে Automatic Writing স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। জিবাক Automatic Writing-কেও মান্যতা দেয়।





১৩. আপনি কি এই রকম সমন্বয়বাদী দর্শনের কথা আগে শুনেছেন?


উঃ    হ্যাঁ। তবে সাহিত্যের ক্ষেত্রে নয়। ধর্মের ক্ষেত্রে। শ্রীকৃপালুজী মহারাজ শ্রীশঙ্করাচার্য শ্রীনিম্বাকাচার্য শ্রীরামানুজাচার্য আর শ্রীমাধবাচার্যের দার্শনিক সিদ্ধান্তকে যথার্থ প্রতিপন্ন করে নিজের সমন্বয়বাদী দার্শনিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে পঞ্চম জগদ্গুরু হিসাবে অভিষিক্ত হন।





১৪. ধর্মের ক্ষেত্রে যা সম্ভব হলো, সাহিত্য বা কবিতার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হল না কেন?

উঃ    দ্যাখো, ভারতবর্ষের শীর্ষস্থ শাস্ত্র বিদ্বানের সভা "কাশী বিদ্বৎ পরিষদ" জগদ্গুরু উপাধি দেয়। সাহিত্য/কবিতার ক্ষেত্রে এধরনের কোনো পরিষদ নেই। এখানে শুধু কোনো বিশেষ গ্রন্থের জন্য সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে কবি/লেখকদের পুরস্কৃত করা হয়। জিবাকের মতো মুক্ত দর্শন মানুষের হৃদয় থেকেই অভিনন্দিত হয়। জিবাককে অসংখ্য মানুষ গ্রহণ করেছেন। যারা এখনো গ্রহণ করেননি তারা ভবিষ্যতে গ্রহণ করবেন বলেই মনে হয়। তুমি Android খুললেই দেখতে পাবে, জিবাকের অগ্রগতির মার্কশীট।




১৫. জিবাক নিয়ে চারদিকে অ্যাতো শোরগোল, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?


উঃ    জিবাক বাংলা ভাষায় লেখা। জিবাকের প্রবক্তা একজন মেধাবী সাধারণ মানুষ। আজ যদি ভলতেয়ার, এলিয়ট অথবা রিলকে জিবাক লিখতেন, এ-সমস্যা হতো না। আর একটা কারণ, চিন্তনে বাউন্ডারি থাকার প্রতিক্রিয়া হতে পারে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন কেউ এগিয়ে এসে বলছেন না, জিবাকের কোন জায়গাটায় তাঁদের আপত্তি আছে।






১৬. আপনার চোখে জিবাকের অপছন্দের জায়গা কিছু আছে?

উঃ   আছে। জিবাক দর্শনে একজায়গায় বলা আছে, "অনাহার, উৎপীড়ন ( বহির্দেশীয় ) আশঙ্কা, ক্ষয়ক্ষতি সমস্ত এক্কেবারেই মিনিমাম লেভেলে নেমে আসবে এবং পৃথিবী হবে একটি মৃগয়াক্ষেত্র---।" এই 'মৃগয়াক্ষেত্র' শব্দটিতে আমার আপত্তি আছে। মৃগয়াক্ষেত্রে অসহায় হরিণদের হত্যা করা হয়। যা মোটেই কাম্য নয়।




১৭. আচ্ছা, আপনার কবিতার ছত্রে ছত্রে পরাবাস্তবতার গন্ধ লেগে থাকে। যেমন কখনো বলেছেন পেপারওয়েটের তৃতীয় চোখের কথা, কখনো বলেছেন গালে টোল পড়া জানালার কথা। এগুলো আপনার ভাবনায় কীভাবে আসে?


উঃ   আধুনিকতার বৃত্তে কবিতাচর্চা করে লক্ষ্য করি, যুক্তিকাঠামোর ভিতর সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পর কবিতা শুধু সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তাই নয়, কবিতার আকর্ষণ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। উত্তরাধুনিক ভাবুকদের কিছু বই সেই সময় আমার হাতে আসে। আমি তাদের বহুরৈখিক বহুকৌণিক বিদিশাময় যুক্তিহীনতার দর্শনে আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। যুক্তিহীন কবিতার কথা ভাবতে ভাবতেই একদিন মগজে ভেসে উঠছে, 'পেপারওয়েটের তৃতীয় চোখ' কবিতাটি। আর একদিন পেয়েছি অচেনা দুটি লাইন :


'দরজা গালে টোল পড়া জানালা পছন্দ করে।
শুধু তাই নয় দরজা গজদন্তঅলা জানালা পছন্দ করে।'




১৮. আপনার লেখা বই এবং পুরস্কার প্রাপ্তি বিষয়ে যদি কিছু বলেন।


উঃ    আমার লেখা একটি কবিতার বই আছে। বইটির নাম "পারফিউমের কোরাস"। "কবিতাপাক্ষিক" আমাকে ২০১২ সালে 'কবিতাপাক্ষিক সম্মাননা' দিয়েছেন।




১৯. আমার শেষ প্রশ্ন, কবিতা আপনাকে কী দিয়েছে?


উঃ    আমি ব্যাপারটাকে উল্টোভাবে দেখি। আমি দেখি, কবিতাকে আমি কী দিয়েছি।



     -- অনেক ধন্যবাদ, সুশীল বাবু।

     --  তোমাকেও ধন্যবাদ, শান্তনু।




2 comments:

  1. খুব ভাল লাগলো আপনার সাক্ষাতকার।

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল লাগলো আপনার সাক্ষাতকার।

    ReplyDelete